গাজার খান ইউনিসে অনিশ্চিত জীবন, যা দেখছেন বিবিসির সংবাদদাতা

Anime BD.com
By -
5 minute read
0


মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে গাজাবাসী

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে গাজাবাসী

  • Author,

গাজার দক্ষিণের শহর খান ইউনিসের ওপর দিয়ে যেন মানবেতর পরিস্থিতির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। শত সহস্র মানুষ গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে যে যা কিছু বহন করতে পেরেছে, তা নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে।

যাদের জ্বালানি আছে তারা গাড়ি করে এসেছে, যারা ঘোড়ার গাড়ি পেয়েছে সেটায় চড়ে এসেছে। আর যারা কিছুই পায়নি তারা নিরুপায় হয়ে পায়ে হেঁটে এসেছে।

এখানে এসে তারা যা দেখতে পেয়েছে তা হল, ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা একটি শহর। যে শহর রাতারাতি দ্বিগুণ পরিমাণ মানুষের ভার নেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়।

প্রতিটি ঘর, প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি রাস্তা নারী-পুরুষ আর শিশুদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

ইসরায়েল গাজা সিটির বাসিন্দাদের তাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে লাখ লাখ মানুষ দক্ষিণের ওই শহরে পা বাড়ায়।

হামাস বলছে, যে ১১ লাখ মানুষ গাজার উত্তরাঞ্চলকে নিজেদের আবাসস্থল বলে এতোদিন ধরে জেনে আসছে, তাদের মধ্যে চার লাখ মানুষ গত ৪৮ ঘণ্টায় সালাহ আল-দিন রোড হয়ে দক্ষিণের দিকে গিয়েছে।

আমি (বিবিসির সংবাদদাতা) তাদের মধ্যে ছিলাম। আমি আমার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং দুই দিনের মতো খাবার নিয়ে খান ইউনিসে এসেছি।

ইসরায়েলে হামাসের বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে ১৩শ মানুষকে হত্যার পর গাজায় ইসরায়েল পাল্টা বোমাবর্ষণ শুরু করে।

ইসরায়েলের এই চলমান হামলা ও সম্ভাব্য অভিযান সত্ত্বেও হামাস গাজাবাসীকে তাদের অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয়। যা অনেক মানুষ গ্রহণ করেনি।

উত্তর গাজা থেকে লাখ লাখ মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

উত্তর গাজা থেকে লাখ লাখ মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের এই সংকীর্ণ উপত্যকা এলাকার চারদিক অবরুদ্ধ এবং বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন, যেখানে সুযোগ-সুবিধা ও বিকল্প অনেক সীমিত, যেখানে নিশ্চিত নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।

তাই এই বিপুল সংখ্যক গাজাবাসী এক জায়গায় জড়ো হয়েছেন। যাদের অনেকে ইতিমধ্যেই বোমা হামলায় তাদের বাড়িঘর হারিয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন, প্রতিনিয়ত আতঙ্কের সাথে বসবাস করছেন, সামনে কী হতে পারে কেউ কিছুই জানে না।

খান ইউনিস শহরটিতে মূলত চার লাখের মতো মানুষ বসবাস করেন। এখন রাতারাতি এই শহরের লোকসংখ্যা বেড়ে ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি, গাজার পূর্ব দিক থেকেও এসেছেন অনেকে, যারা ২০১৪ সালের যুদ্ধে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

তাদের প্রত্যেকেরই আশ্রয় এবং খাবারের প্রয়োজন, এবং সেটা কতদিন ধরে দরকার হবে কেউ জানে না।

খান ইউনিসের কয়েকটি পানির স্টেশনে পানির জন্য মানুষের ভিড়।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

খান ইউনিসের কয়েকটি পানির স্টেশনে পানির জন্য মানুষের ভিড়।

পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে

গাজার সীমিত যে সম্পদ রয়েছে সেটাও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এটি এমন এক শহর যা ইতিমধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

আর এখন জনস্রোত এতোটাই বড় আকার নিয়েছে যে সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু হয়েছে।

এখানকার প্রধান হাসপাতালটি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে ভুগছিল। এখন এখানে শুধু অসুস্থ ও আহতরাই আসছেন না-বরং হাসপাতালটি উত্তরাঞ্চল থেকে আসা এই মানুষগুলোর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।

বাস্তুচ্যুত এই মানুষেরা হাসপাতালের করিডোরে লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন। আর চিকিৎসকরা ইসরায়েলি বোমার আঘাতে আহত নতুন এই মানুষদের সেবায় কাজ করছেন।

তাদের আহাজারি আর প্রার্থনার স্বরে ভারী হয়ে পড়েছে আশেপাশের বাতাস।

এখানে আসার জন্য আপনি কোন মানুষকে দোষ দিতে পারবেন না।

কারণ যুদ্ধের সময়ে হাসপাতালগুলো আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত সবচেয়ে নিরাপদ স্থানগুলোর মধ্যে একটি।

এমন কিছু ব্যবস্থার কারণে হাসপাতালের এই আহত মানুষগুলো সম্ভবত ভাগ্যবান, অন্তত এখনকার মতো ভাগ্যবান বলাই যায়।

চিকিৎসকরা বলছেন যে, নতুন হতাহতের স্রোত সামাল দেয়ার মতো তাদের কাছে প্রায় কিছুই নেই।

রোগীদের জন্য দিনে জনপ্রতি তিনশ মিলিলিটার পানি সরবরাহ করা হয়। শরণার্থীরা তার কিছুই পায় না।

তবে খান ইউনিসের বাসিন্দারা নতুন আসা এই মানুষদের সাদরে গ্রহণ করেছে। খান ইউনিস আগে থেকেই বেশ ঘনবসতি এলাকা অর্থাৎ অনেক মানুষ অল্প জায়গায় বসবাস করতেন।

এখন নতুনরা আসায় তারা রীতিমতো ঠাসাঠাসি করে থাকছেন।

স্কুলে আশ্রিত মানুষেরা বাইরের আঙিনায় রান্না করছেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

স্কুলে আশ্রিত মানুষেরা বাইরের আঙিনায় রান্না করছেন।

আমি সেখানকার বিভিন্ন ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরে দেখেছি, যেখানে ধারণ ক্ষমতার বেশি মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।

এই ছোট ছোট ফ্ল্যাটগুলো ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। কেউ এভাবে বেশি দিন বাঁচতে পারে না।

আমার পরিবার এখন অন্য আরও চারজনের সাথে দুটি ছোট বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটে ভাগাভাগি করে থাকছে। আমরা অন্তত কয়েক মিটারের মতো ব্যক্তিগত স্থান পেয়েছি। এজন্য আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি।

শহর জুড়ে থাকা স্কুলগুলো, যুদ্ধ থেকে "নিরাপদ" স্থান বলে বিবেচিত। এই স্কুলগুলো অসংখ্য পরিবারে পরিপূর্ণ – এসব মানুষের সংখ্যা হাজার হাজার, নিশ্চিতভাবে কে জানে? আপনি হয়তো গুনেও শেষ করতে পারবেন না।

জাতিসংঘের ত্রাণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ দ্বারা পরিচালিত একটি স্কুলের, প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ, প্রতিটি বারান্দার জায়গা লাইন ধরে মানুষের কাপড় ঝোলানো।

মা এবং দাদিরা উঠোনে না হলে পার্কের বেঞ্চে রান্না করছেন কারণ তাদের ক্ষুধার্ত শিশুরা অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে।

কিন্তু যখন আর কোন জায়গা থাকে না – এবং আসলেই কোন জায়গা থাকে না – তখন এই মানুষগুলো অনিবার্যভাবে রাস্তায় ছিটকে পড়ে।

গাজার এই শহরের অলিগলি এবং আন্ডারপাসগুলো মানুষে মানুষে ছেয়ে গিয়েছে। ধুলা, ময়লা, এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এই মানুষগুলো জীবনযাপন করছে, ঘুমাচ্ছে।

তারা অপেক্ষা করছে আরও ভাল কিছুর জন্য, যে অপেক্ষার প্রহর হয়তো কখনোই ফুরাবে না।

এখানে খাদ্য সীমিত, জ্বালানী সীমিত, দোকানপাটে কোথাও কোন পানি নেই। পানির স্টেশনগুলোই একমাত্র ভরসা, সব মিলিয়ে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি।

খান ইউনিসে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

খান ইউনিসে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন।

আর এই শহর যে হামলা থেকে নিরাপদ, সেটাও বলা যাবে না। এখানেও নিয়মিত বোমা হামলা হচ্ছে।

পালিয়ে আসা মানুষগুলো এখনও একটি যুদ্ধক্ষেত্রেই আছে। ধসে পড়া ভবন ও আবর্জনার স্তূপ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

হামাস যখন ইসরায়েলের ভেতরে হামলা চালাচ্ছিল তখন আমি হাসপাতালের কাছাকাছি ইসরায়েলি রকেট হামলার শব্দ শুনতে পাই।

কারণ হামাস ওই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলকে প্রতিশোধমূলক হামলার চালানোর খোলা আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

ইসরায়েলি ড্রোনগুলো এখনও গুঞ্জন তুলে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য খুঁজছে।

এরপর বোমা পড়ছে, ভবনগুলো ধসে যাচ্ছে। এবং মর্গ এবং হাসপাতালগুলো আরও মানুষে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

আজ সকালে আমার পরিবারের বাড়ির কাছে একটি বোমা পড়ে। সমস্ত টেলিফোন পরিষেবা বন্ধ বা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার কারণে, আমার ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে ২০ মিনিট সময় লেগে যায়।

মানুষ এভাবে বাঁচতে পারে না।

গাজায় ইসরায়েলি অভিযান যেকোনো সময় শুরু হতে পারে।

আমি আমার আবাসস্থল গাজায় এ নিয়ে চারটি যুদ্ধ কভার করেছি। আগে কখনো এতোটা মানবেতর পরিস্থিতি দেখিনি।

আগের যুদ্ধগুলো যত খারাপই হোক না কেন, আমি কখনো এক জায়গায় এতো মানুষকে ক্ষুধা বা পিপাসায় মরতে দেখিনি। এটি এখন এখানকার বাস্তবতা।

মিশরের রাফাহ সীমান্ত

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

মিশরের রাফাহ সীমান্ত

গাজা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র বিকল্প হল মিশরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ওই পারে যাওয়া, কিন্তু ওই রাফাহ ক্রসিংও, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কায়রো জানে যে ওই সীমানা খুলে দিলে একটি নতুন মানবিক বিপর্যয়ের সূচনা হবে।

রাফাহ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অন্তত ১০ লাখ উদ্বাস্তু গাজাবাসী এখন অপেক্ষায় আছে। সীমানা একবার খুলে দিলে এখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।

আমি ২০১৪ সালে একই পরিস্থিতি দেখেছিলাম, যখন হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধ থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল। এখনকার পরিস্থিতি আরও অনেক খারাপ - এমনটাই আশঙ্কা করছে মিশর।

সীমানা খুলে দিলে মানুষের স্রোত সীমান্তে আছড়ে পড়বে যা আরেক ধরনের বিপর্যয় এবং বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে।

বিদেশি পাসপোর্টধারী অনেক গাজাবাসী রাফাহ সীমান্তে জড়ো হয়েছেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,

বিদেশি পাসপোর্টধারী অনেক গাজাবাসী রাফাহ সীমান্তে জড়ো হয়েছেন।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Nosso site usa cookies para melhorar sua experiência.Ver Agora
Ok, Go it!