বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ তখন সবে শুরু হতে চলেছে। গত ৭ অক্টোবর ধরমশালায় যখন বাংলাদেশ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সে সময়ই গাজা থেকে হামাস অতর্কিত হামলা চালায় ইসরায়েলি ভূখণ্ডে – যে আক্রমণের অভিঘাতে মধ্যপ্রাচ্য এখন এক বিধ্বংসী যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি এবং বর্তমান বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ভারতের জন্য ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের এর চেয়ে খারাপ ‘টাইমিং’ বোধহয় আর হতে পারত না।
অলিম্পিক বা বিশ্বকাপের মতো মেগা স্পোর্টিং ইভেন্ট যখন চলে, তখন আইওসি, ফিফা বা আইসিসি-র মতো সংগঠনগুলো কখনোই চায় না বড় কোনও যুদ্ধবিগ্রহে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের মনোযোগ খেলাধুলো থেকে সরে যাক।
কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হতে না-হতেই যেভাবে মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠেছে তাতে আইসিসি-র কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অবধারিতভাবে।
এখন বিশ্বকাপের মঞ্চকে যাতে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক মেসেজিংয়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার না-করা হয়, বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপণে।
যদিও বিষয়টির সংবেদনশীলতা মাথায় রেখে আইসিসি এ নিয়ে এখনো কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
কিন্তু এরই মধ্যে পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ রিজওয়ান বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাদের স্মরণীয় জয়কে উৎসর্গ করেছেন ‘গাজার ভাই বোনদের’ উদ্দেশে।
তার দু’দিনের মধ্যে পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম সাংবাদিক সম্মেলনে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি ক্রিকেটের বাইরে আরও কোনও প্রসঙ্গে ঢুকতে চান না। অর্থাৎ এই প্রশ্নে তিনি রিজওয়ানের সঙ্গে দূরত্বই রাখতে চান।
এরই মধ্যে শনিবার আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় ভারতের কোনও কোনও সমর্থক স্টেডিয়ামে ইসরায়েলের সমর্থনে ব্যানার ও পোস্টার প্রদর্শন করেছেন।
সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উল্লাস ব্যক্ত করেন।
এমন কী, ম্যাচটায় হেরে গিয়ে পাকিস্তান যে তাদের জয় “হামাস সন্ত্রাসবাদীদের উৎসর্গ করতে পারেনি” – সে জন্যও দারুণ খুশি হয়েছেন ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত।
ফলে আইসিসি বা বিসিসিআই যতই চেষ্টা করুক, বিশ্বকাপের আসরেও কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের ছায়া পড়ছে অনিবার্যভাবেই।
বিবিসি জানতে পেরেছে, এই চলমান সঙ্কটে যুদ্ধরত কোনও পক্ষের সমর্থনে কোনও দলের ক্রিকেটাররা যাতে আর্মব্যান্ড বা ওই রকম কিছু না পরেন – সে ব্যাপারেও মৌখিকভাবে দলগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে আইসিসি।
বস্তুত খেলার মাঠে যাতে ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো না-হয়, টুর্নামেন্টের জন্য আইসিসি-র নির্দেশিকাতেই সেটা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে।
তবে বিশ্বকাপে যে মোট দশটি দেশ খেলছে, তার মধ্যে একাধিক দেশের সরকার স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের প্রতি এবং অন্য আরও কয়েকটি দেশের সরকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি ব্যক্ত করেছে ইতিমধ্যেই।
কিন্তু সেই দেশগুলোর ক্রিকেটাররা যাতে বিশ্বকাপের সময় কোনও রাজনৈতিক বার্তা না-দিতে পারেন, আইসিসি-কে এখন তার জন্যই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে!
রিজওয়ানের গাজা মন্তব্য
গত ১০ অক্টোবর হায়দ্রাবাদে প্রায় সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি রান তাড়া করে যে ম্যাচে পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছিল, সেই জয়ের নায়ক ছিলেন মুহাম্মদ রিজওয়ান।
পাকিস্তানের এই উইকেটকিপার-ব্যাটার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে খেলেও ১৩১ নট আউটের দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি করে দলকে সে দিন ম্যাচ জেতান।
ম্যাচের পর দিন দুপুরবেলা নিজের এক্স হ্যান্ডল থেকে তিনি পোস্ট করেন, “এটা ছিল গাজা-তে আমাদের ভাই ও বোনদের জন্য।”
সঙ্গে একটি ইবাদত বা প্রার্থনার ইমোজি দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন, গাজার জন্য সহমর্মিতা প্রকাশ করছেন তিনি।
কিন্তু এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষ করে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরার রিজওয়ানকে তীব্র আক্রমণ করা শুরু করেন – ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর অভিযোগ আনা হতে থাকে তার বিরুদ্ধে।
অনেকেই আবার আইসিসি-কে ট্যাগ করে তাদের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং রিজওয়ানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানাতে থাকেন।
গত শুক্রবার আহমেদাবাদে ভারত-পাকিস্তান খেলার আগে প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজমকেও রিজওয়ানের পোস্ট নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
বাবর আজম কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “ভাল হয় যদি আপনারা কালকের ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করেন!”
“ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু খেলার বাইরে আর কোনও কিছু নিয়েই আমি আসলে কিছু বলতে চাই না”, জানিয়ে দেন তিনি।
বাবর আজমের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে, মুহাম্মদ রিজওয়ান যা বলেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত মতামত – দল হিসেবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে তার সমর্থনে এগিয়ে আসছে না।
End of Twitter post, 1
আইসিসি-র একজন মুখপাত্র এ প্রসঙ্গে আরও জানিয়েছেন, “মাঠের বাইরের কোনও ঘটনা নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে চাই না!”
তিনি আরও দাবি করেন, এখানে যে ইস্যুতে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা মুহাম্মদ রিজওয়ান আর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) মধ্যেকার ব্যাপার – ফলে আইসিসি এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
তবে আইসিসি বিষয়টি নিয়ে পিসিবি-র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছে কি না, মুখপাত্র সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন।
ইসরায়েলের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
রিজওয়ানের মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের রেশ মিটতে না-মিটতেই শনিবার বিশ্বকাপে আবার ইসরায়েল প্রসঙ্গ টেনে আনেন দর্শকদের একাংশ।
আহমেদাবাদে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাতেগোনা কয়েকজন সমর্থক ইসরায়েলের প্রতি ভারতের সংহতি ও সমর্থন জানিয়ে পোস্টার তুলে ধরেন।
এর মধ্যে হর্ষল পুরোহিত নামে এক ব্যক্তির তুলে ধরা পোস্টারের ছবি ভাইরাল হয়ে যায় – যাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখা যায়।
শনিবার রাতেই সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘পোস্ট’ করে ভারতীয় সমর্থকদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানান ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন।
End of Twitter post, 2
নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি লেখেন, “ওই ম্যাচের সময় পোস্টার প্রদর্শন করে আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা যেভাবে ইসরায়েলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন, তাতে আমরা সত্যিই অভিভূত!”
এমন কী বিশ্বকাপের ওই ম্যাচটিতে ভারত জেতায় (এবং পাকিস্তান হারায়) ইসরায়েল যে অত্যন্ত খুশি হয়েছে, সেটা জানাতেও তিনি কোনও রাখঢাক করেননি।
“কারণ ম্যাচটা জিতে পাকিস্তান তাদের জয় হামাসের সন্ত্রাসবাদীদের উৎসর্গ করার কোনও সুযোগ পায়নি!”, মন্তব্য করেছেন মি গিলন।
ইসরায়েল আইসিসি-র একটি সহযোগী সদস্য (অ্যাসোসিয়েট মেম্বার) দেশ – বস্তুত গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ইসরায়েল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আইসিসি-র সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু রাষ্ট্রদূত নাওর গিলনের মন্তব্য নিয়ে আইসিসি তাদের এই সহযোগী সদস্যর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এদিকে আহমেদাবাদের আগে ধরমশালাতেও গত মঙ্গলবার গ্যালারি থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘জয় মাতা দি’-র মতো হিন্দুত্ববাদী স্লোগান উঠেছিল। মাঠে তখন চলছিল বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের খেলা।
তবে ওই স্লোগানের সঙ্গে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কোনও সম্পর্ক ছিল কি না, তা অবশ্য পরিষ্কার নয়।