ভারতের বিপক্ষে সিরাজের বলে বোল্ড হন বাবর আজম। পাকিস্তানের ইনিংসে ধসের শুরু এখান থেকেই। সেই ম্যাচে ২ উইকেটে ১৫৫ রান থেকে পাকিস্তানের ১৯১ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা কম হয়নিছবি: রয়টার্
দলগুলোর দিকে একবার তাকানো যেতে পারে—পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা। পরাশক্তি এই দলগুলোয় কী দুর্দান্ত সব ‘রানজীবী’ই না আছেন! নামগুলো একবার পড়ে নেওয়া যেতে পারে—বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান, সৌদ শাকিল, স্টিভ স্মিথ, মারনাস লাবুশেন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, জো রুট, জশ বাটলার, রেসি ফন ডার ডুসেন, এইডেন মার্করাম, হাইনরিখ ক্লাসেন, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, চারিত আসালাঙ্কা।
জয় গোস্বামী সমুদ্রে পা ডুবিয়ে ছপছপ কবিতায় যেমনটা লিখেছেন—সমুদ্রে পা ডুবিয়ে ছপছপ/ যে-ধীবর হাঁটে/ মাথার টোকাটি উল্টে ধ’রে/ যে পায় টুপটাপ উল্কা। চাঁদ। কবিতার এই মৎস্যজীবীর মতো নিজেদের ক্যারিয়ার-টোকায় কত রান এখন পর্যন্ত জমা করেছেন এই রানজীবীরা। টুপটাপ মেরেছেন কত ছয় আর চার! মাছ ধরতে ধরতে এক সকালে জয় গোস্বামীর সেই মৎস্যজীবী হঠাৎই অকালে আর বেঘোরে হারিয়ে যায়—সমুদ্রের ছাদ ফুটো ক’রে একটি উষায় তার মাথাটি আগুন লেগে ফাটে। এর কারণটাও সহজ আর সরল—তোমার ধৈর্যের ভাঙে বাঁধ।
এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে মহারথী রানজীবীদের অবস্থা যেন ঠিক এমনই। রান ‘ধরতে ধরতে’ হঠাৎই বাবর, লাবুশেন, রুটদের মাথাটি আগুন লেগে ফাটে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বাবর হঠাৎই আউট হয়ে ফেরেন মোহাম্মদ সিরাজের বলে বোল্ড হয়ে। লাবুশেন সামলাতে পারেন না রবীন্দ্র জাদেজার ঘূর্ণি। মুজিব উর রেহমানের স্পিনে খাবি খান রুট, বাটলার সামলাতে পারেন না নাভিন উল হককে!
এসব কারণেই তো লক্ষ্ণৌতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ উইকেটে ১৫৭ রান থেকে শ্রীলঙ্কা অলআউট হয়ে যায় ২০৯ রানে। আহমেদাবাদে পাকিস্তানের ব্যাটিং ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ২ উইকেটে ১৫৫ রান থেকে পাকিস্তানের ১৯১ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি, এখনো হচ্ছে।
দিল্লিতে ‘পুঁচকে’ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ইনিংসও খেই হারিয়েছে এমন আকস্মিক ধসে। ৩ উইকেটে ৯১ রান থেকে তাদের ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। ৪৭ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে হয়ে গেছে তারা ৬ উইকেটে ১৩৮ রান। ২৮৫ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে শেষ পর্যন্ত অলআউট হয়েছে ২১৫ রানে।
এই বিশ্বকাপের একমাত্র টেস্ট না খেলা দল নেদারল্যান্ডসের কাছে এভাবেই হাবুডুবু খেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ২৪৫ রান তাড়া করতে নেমে ২০৭ রানে অলআউট হয়েছে প্রোটিয়ারা। ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেটে ১১০ থেকে ১৯৯ রানে অলআউট হয়ে হেরেছে ৬ উইকেটে। গতকালও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪০০ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ। ৬৮ রানে ৬ উইকেট হারানো ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত অলআউট হয়েছে ১৭০ রানে। এই বিশ্বকাপে বড় দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বড় কোনো ধসে পড়েনি শুধু ভারত আর নিউজিল্যান্ড।
জয় গোস্বামীর মৎস্যজীবী সমুদ্রের কোন জায়গায় খেই হারিয়েছেন, কবি সেটা কবিতায় লেখেননি। কিন্তু এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে মহারথী রানজীবীরা হাবুডুবু খাচ্ছেন মাঝসমুদ্রে। ওয়ানডে ম্যাচের শুরুর ১০ ওভার আর শেষের ১০ ওভারকে দুই কিনার ধরলে মাঝের ১১ থেকে ৪০তম ওভারকে বলা যায় গভীর বা মাঝসমুদ্র। সেদিক থেকে মাঝের ওভারের এই ধসকে তো মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া বলাই যায়!
কিন্তু প্রশ্ন হলো—বাবর, রিজওয়ান, স্মিথ, লাবুশেন, রুট, ক্লাসেনদের মতো রথী-মহারথী ব্যাটসম্যানরা কেন মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ মানুষই হয়তো একটি কথাই বলবেন—মাঝসমুদ্রে সাঁতার কাটার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এই রানজীবীদের নেই। এঁরা আসলে সৈকতে সাঁতার কেটেই অভ্যস্ত।
সত্যি বলুন আর বাস্তবতা, তা আসলে এটাই। ক্রিকেটের আধুনিক এই যুগে ক্রিকেটাররা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে এত বেশি সাঁতার কাটছেন যে ওয়ানডে বা ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ডুব দেওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না! কয়েক বছর ধরে সুনীল গাভাস্কার-কপিল দেবসহ অনেক সাবেক ক্রিকেটারকেই ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা গেছে।
বিশ্লেষক থেকে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী, গবেষক থেকে পাঠক—ক্রিকেটের যেকোনো মহলেই কান পাতলে ইদানীং একটা কথা শোনা যায়, ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নেই! কেউ কেউ আবার বলছেন, ভবিষ্যতে হয়তো শুধু বিশ্বকাপেই খেলা হবে। টি-টোয়েন্টির ছড়াছড়ির মধ্যেও ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্ট এখনো টিকে আছে। কিন্তু এ দুটির জাতাকলে পড়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের ত্রাহি অবস্থা।
ওয়ানডে ক্রিকেট বিভিন্ন দল আর খেলোয়াড়দের কাছে কতটা ‘অচ্ছুতপ্রায়’ হয়ে উঠেছে, সেটা বোঝাতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সূচির ক্ষতি যেন না হয়, এ কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সুপার লিগের সিরিজ বাতিল করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। যে কারণে তাদের বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছিল।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মাঝের ওভার বলতে আসলে তেমন কিছু নেই। খেলাটাই যখন ২০ ওভারের, দলগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেরে খেলে। সেখানে উইকেট বাঁচিয়ে রাখা মুখ্য নয়। যত বেশি রান তোলা যায়, সেটাই লক্ষ্য। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটে লম্বা সময় ব্যাটিং করতে হয় দলগুলোকে। এখানে প্রয়োজন বিপদ এলে তা উত্তরণে মাথা ঠান্ডা রাখা। পর্যাপ্ত ওয়ানডে না খেলায় সেই অভ্যাসই তো তৈরি হচ্ছে না এখনকার রানজীবীদের। এ কারণেই মাঝের ওভারে এমন ধসের ঘটনা ঘটছে।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে আর এখন বিশ্বকাপ চলার সময় এ নিয়ে সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর মাঝের ওভারের ধস নিয়ে কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, নিউজিল্যান্ডের টম ল্যাথাম।
কামিন্স বলেছেন, ‘প্রতিপক্ষ ভালো বোলিং করলে (মাঝের ওভারে) আমরা কীভাবে জুটি গড়তে পারি, সেটাই দেখার বিষয়। ওয়ানডে ক্রিকেটে (টি-টোয়েন্টির মতো) বড় ঝুঁকি না নেওয়াটা একটা ব্যাপার। আবার টেস্টের মতো খেললেও চলবে না। আপনাকে রানের চাকা ঘোরাতে হবে।’ ল্যাথামের কথা ছিল এ রকম, ‘মাঝের ওভারে আপনি কীভাবে আক্রমণাত্মক থাকবেন, এটাই সাদা বলের ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জ।’
মাঝের ওভারে আপনি আক্রমণাত্মক খেলেন বা ধরে খেলেন, একটা জিনিস আপনার লাগবেই, সেটা ধৈর্য। আর নিজের মধ্যে সেই ধৈর্য ধারণ করার জন্য নিশ্চিত করেই প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। নোবলেজয়ী লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর ‘যদি’ কবিতায় যেমন লিখেছেন—যদি তুমি তোমার হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু আর পেশিকে তোমার পালা চলে যাওয়ার অনেক পরেও কাজ করতে বাধ্য করতে পারো, তখনো...যখন তোমার ভেতরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই কেবল ইচ্ছাশক্তি ছাড়া, যা বলছে ‘লেগে থাকো।’
এই যে ধৈর্য, ইচ্ছাশক্তি আর লেগে থাকা; এর জন্য প্রয়োজন অনুশীলন। আর এ তো জানা কথাই, অনুশীলন গড়ে দেবে অভ্যাস। সেটাই তো তৈরি হচ্ছে না বাবর, স্মিথ, রুটদের! এ কারণেই এত ধসের গল্প এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে।